মনের মানুষঃ একটি ভালোলাগা চলচ্চিত্র, কিন্তু......

আমার খুব প্রিয় একজন লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসকে অবলম্বন করে আরেক প্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ ছবি তৈরি করেছেন, নাম দিয়েছেন উপন্যাসের নামে ‘মনের মানুষ’। ছবিটি ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় ২০১০ সালের ৩রা ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছে। দেখবো দেখবো করে অনেক দেরীতে আমি ছবিটি দেখেছি, তাও সিনেমা হলে গিয়ে নয়। ছবিটি ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে অন্যতম বাউল সাধক লালন শাহের জীবন দর্শনকে নিয়ে নির্মিত। ছবিটি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, আমি চিত্র সমালোচক নই। আমি শুধুমাত্র ছবিটি দেখতে গিয়ে আমার অনুভুতি আর প্রাসঙ্গিক কিছু কথা লেখার জন্যই আজ লিখতে বসেছি।

ছবিটির প্রথমেই দেখানো হয়েছে একটি আপাতদৃষ্টিতে মৃতদেহ ভেলায় করে নদীতে ভেসে চলছে। তারপরেই দেখা গেলো লালন চন্দ্র কর নামে এক যুবকের সাথে সিরাজ সাঁইয়ের পরিচয় হয়। যুবকটি সিরাজ সাঁইকে তাঁর গাওয়া গানটার মানে জিজ্ঞেস করলে সাঁইয়ের একটা কথা আমার খুব ভালো লাগে, ‘আহম্মক ছাড়া কেউ গানের মানে খুঁজে না’। আমি নিজেও এইসব আধ্যত্মবাদী গানের মানে খুব একটা বুঝতে পারি না, মানে বোঝারও চেষ্টা করি না, কিন্তু শুনতে খুব ভালো লাগে, মন জুড়িয়ে যায়। তারমানে আমি আহাম্মক নই, তাই না!

এরপরেই দেখা গেলো লালন চন্দ্র কর নামের যুবকটিই হচ্ছে লালন শাহ। আমি এখানে একটূ হোঁচট খেলাম। আমি যতদূর জানতাম, লালন কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন বা তাঁর জন্মগত ধর্ম কি ছিলো, সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষনা করেও জ্ঞানী গুণী গবেষকরা কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেন নি। কেউ বলেন লালনের জন্ম যশোর জেলার ফুলবাড়ি গ্রামের একটি মুসলিম পরিবারে, আবার কারো মতে লালন কায়স্ত পরিবারের সন্তান যার পিতা মাধব এবং মাতা পদ্মাবতী। পরে লালন ধর্ম পরিবর্তন করেন। গবেষকদের একাংশ মনে করেন লালন মুসলিম তন্তুবায় পরিবারের সন্তান। পিতা দরিবুল্লাহ দেওয়ান, মাতার নাম আমিনা খাতুন। অর্থাৎ লালনের জন্ম সম্পর্কে আজো পর্যন্ত কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব হয় নি। লালন নিজেও বলেছেন,

“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে
লালন কয় জাতের কিরুপ
দেখলাম না এই নজরে”।

অথবা,

“সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন
লালন বলে আমার আমি
না জানি সন্ধান”।

সেখানে ছবিতে তাঁর হিন্দু ঘরে জন্মানো দেখানোটা প্রকৃত তথ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, তাই নয় কী?

একটু পরেই আমরা দেখতে পাই বৃদ্ধ লালন শাহ বজরাতে বসে আছেন, এক শহুরে কেতাদুরস্ত ব্যক্তি তাঁর পোর্ট্রেট আঁকছেন। একপর্যায়ে লালন ফকিরকে জিজ্ঞেস করছেন, “তুমি কী বাউল ফকির? কথায় কথায় গান বান্ধো? তুমি কে গো?” উনি লালন ফকিরকে সুধাচ্ছেন তুমি কে গো, অথচ তখনো আমরা জানতেই পারছি না এই কেতাদুরস্ত মানুষটি কে? অবশ্য কিছুপরের এক দৃশ্যে লালনের পোর্ট্রেটে স্বাক্ষর দেবার সময় দেখতে পাই মানুষটির নাম জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর থেকে বারো বছরের ছোটো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁকে উৎসাহ ও সঙ্গ দিয়ে তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশে সহায়তা করেন। ছাত্রাবস্থাতেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থিয়েটারের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর রচিত একটি নাটকের নাম ছিলো ‘সরোজিনী’। এই নাটকটির সাথে রবীন্দ্রনাথ কিছুটা জড়িত আছেন। নাটকটি যে ঘরে রচনা হত, তার পাশের ঘরে কিশোর রবীন্দ্রনাথ সংলাপ শুনতেন। সরোজিনী তৈরির সময় রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করেন, সরোজিনী জ্বলন্ত আগুনে হেঁটে আত্মাহুতি দিতে যাচ্ছে এই দৃশ্যটির পিছনে উক্তি ব্যবহার না করে গান ব্যবহার করতে হবে এবং এই গানটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন। অঙ্কন ও স্কেচ করার দিকে আগ্রহী ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। নিজের পরিবারের অনেক সদস্যের পোর্ট্রেট তিনি আঁকেন। ছবিতে দেখা যায় তিনি লালনের পোর্ট্রেট আঁকছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। কোনো এক সময়ে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাবে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে বরঞ্চ লালনের ভাল সম্পর্ক ছিলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনের সাথে কথা বলে তাঁর ২৯৮ টি গান সংগ্রহ করেছিলেন। তাই আমার কাছে মনে হয়েছে, লালনের সাথে জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে না দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথকে দেখালেই যুক্তিসঙ্গত হতো।

এরপরেই আমরা দেখি, লালন ফ্লাসব্যাকে চলে গেছেন। ফ্লাসব্যাকে দেখা যায়, কিশোর লালন কবিরাজকে গান শোনাচ্ছে, “আর আমারে মারিস নে মা, ননী চুরি আর করবো না”। আমি জানি না, লালনের জলবসন্ত হওয়ার আগে এই গান রচিত হয়েছিলো কী না। তাছাড়া তখন লালনের গান সংগ্রহ করার মতো তেমন কেউ ছিলো না। আর বাউল হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভের পরই।

এখানে একটা ব্যাপারে আমি একটু বলে নেই, যেহেতু পেশাগত কাজের সাথে জড়িত। ছবিতে যখন লালনের জ্বর হয়েছে, বলা হয়েছে কম্বল দিয়ে শরীর ঢাকতে। আধুনিক চিকিৎসায় এখন বলা হয়ে থাকে, জ্বর হলে শরীর থেকে সব কাপড় সরিয়ে ফেলতে। আর মৃত মনে করে ভেলায় ভাসিয়ে দেবার পর, বেঁচে থাকা বা বেঁচে উঠাকে আমার কাছে মনে হচ্ছে trans death-এর মতো। ট্রান্স ডেথ মানে হচ্ছে সোজা কথায় মৃত্যুর মতো মনে হবে, কিন্তু মারা যায় নি। ভাওয়াল রাজপরিবারের সন্যাসীর কাহিনীর সাথে এই ট্রান্স ডেথের খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। আরেকদিন এটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে। trans death-এর ব্যাপারটা মাথায় থাকে বলেই ডাক্তাররা সবসময় কোনো রোগী মারা গেলে, মারা যাবার প্রায় ৩০ মিনিট পর মৃত্যুর ঘোষনা দেয়।

ছবিটির এই পর্যায়ে এসে আমি আবার হোঁচট খাই। দেখানো হয়েছে নদী থেকে রাবেয়া নামে এক মুসলমান মহিলা তাঁকে উদ্ধার করেন। অথচ লালন নিজেই বলেছেন, বসন্ত রোগের পর যে মহিলার সেবায় তিনি সুস্থ হয়েছিলেন, যাকে ‘মা’ বলে ডাকতেন, তার নাম মতিজান। মতিজান লালনকে নদীর পাড়ে প্রথম খুঁজে পেয়েছিলেন এই তথ্যও কোথাও নেই। এখানেও লালন নিজেই গানে বলেছেন,

“আমি লালন এক শিরে
ভাই বন্ধু নাই আমার জোড়ে
ভুগেছিলাম পকসো জ্বরে
মলম শাহ করেন উদ্ধার।”

মলম শাহ হচ্ছেন মতিজান এর স্বামী। মলম শাহ এবং মতিজান পরবর্তী জীবনে লালনের প্রতি অপরিসীম ভক্তি ও অনুরাগে অনুপ্রাণিত হয়ে লালনের ভাবধারায় মিশে গিয়ে হয়ে যান ফকির মলম শাহ এবং মতিজান ফকিরানী। ছেউড়িয়ায় লালনের সমাধি পাশেই রযেছে মতিজান ফকিরানী এবং মলম শাহের সমাধি। লালন, মতিজান ফকিরানী আর মলম শাহ আমৃত্যু ছেউরিয়াতে একসাথে ছিলেন। অথচ মনের মানুষে সিরাজ সাঁই লালনকে রাবেয়া আর স্বামীর ঘর থেকে বের করে নিয়ে যায় আর কখনও লালনের জীবনে সেই মুসলমান বাবা মায়ের উপস্থিতি দেখানো হয় না।

এখানে আরেকটি জিনিস আমার কাছে ঠিকমতো বোধগম্য হয়নি। রাবেয়ার স্বামী রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলো, “আমাদের জাতের না, বুঝলি কি করে?” রাবেয়ার উত্তর ছিলো, “আমি ওর কাপড় বদলাইছি না!” খৎনা না করানো থাকলেই কী সে মুসলমান হতে পারবে না? বা অমুসলিম কেউ কী খৎনা করায় না?

এরপরেই লালনের সাথে আবার দেখা হয় তাঁর গুরু সিরাজ সাঁইয়ের। সিরাজ সাঁই জাতিতে মুসলমান এবং পেশায় পাল্কী বাহক বেহারা সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। নিরক্ষর লালনকে তিনি লেখাপড়া শেখাবার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলছিলেন, “এই দুনিয়ায় দুইটাই জাত, পুরুষ আর নারী, বাকী সব মানুষের অনাসৃষ্টি”। তিনি গান গেয়েছেন,

“জলের উপর পানি,
না পানির উপর জল,
আলীর উপর কালী,
না কালীর উপর আলী,
বল খোদা বল, বল খোদা বল”।

লালন শাহের স্মৃতিশক্তি ফিরে এলে লালনকে একটা চমৎকার কথা বলেন, “সময় বুঝে নিজেরে গোপন করা লাগে, আবার সময় বুঝে নিজেরে প্রকাশ করা লাগে”। কথাগুলো শুনতে ভালোই লেগেছে। সিরাজ সাঁইয়ের প্রতি মনটা শ্রদ্ধায় ভরে উঠে। কিন্তু যখন নিজের বাড়ি থেকে আসার পর লালনকে সাধন-সঙ্গী্র প্রয়োজন বলে ময়ূরী নামে কামুক নারীর কাছে পাঠায়, আর বলে, “নারীর অন্তরে ইর্ষা, চক্ষে কামনা” বা “নারীই হলো আনন্দ সহচরী, মহামায়া, তিনি সৃষ্টি আর স্থিতির জননী, আবার লয়-বিলয়ের মহা শক্তি”, তখন তাকে সামান্য একজন দালালের মতোই লাগে, কিন্তু আমি জানি সিরাজ সাঁইয়ের চরিত্র এরকম ছিলো না, তাহলে কেনো তা দেখানো হলো? খুব কী প্রয়োজন ছিলো সেই মেয়েটির মুখ দিয়ে “পারবে অমাবশ্যায় পূণির্মা জাগাতে?” বলানো এবং তারপরে লালনের সাড়া দেবার দৃশ্যটিকে দেখানো?

লালন নিজের বাড়িতে গিয়ে নিজের পরিচয় দেবার পর যখন লালনের মা বলে, “জাত গেছে, যবনের হাতে অন্ন খেয়েছিস”, এবং তারপর লালনের ধর্ম নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি্র পরিবর্তন দেখে মনে হয়েছে, যে ব্যক্তিটি আজীবন নিজের ধর্ম পরিচয়টিকে লুকিয়ে রাখলেন, তাঁর জন্য এই একটিমাত্র ঘটনাই কী টনিক হিসেবে কাজ করলো? আমার কেনো জানি মনে হলো এখানে লালনকে ছোট করা হয়ে গেলো।

ছবিতে এরপরে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। কালুয়া এবং কলমি। একজন মহান ব্যাক্তিকে নিয়ে বায়োগ্রাফিক্যাল মুভিতে এই দুইটি কাল্পনিক চরিত্রের কী আদৌ প্রয়োজন ছিলো? যেখানে দেখানো হয়েছে, অন্ধকার ঘরে লালন একলা বসে আছেন। কলমি এসে লালনের সাথে কথা বলার অনুমতি নিয়ে হঠাৎ করে লালনের কাঁধে মুখ ঘষতে থাকে, বলতে থাকে “আমার জ্বালা মিটিয়ে দেও গো সাঁই”, এরপর কলমির হাত এবং মুখ লালনের গা বেয়ে নিচে নামতে থাকে। আস্তে আস্তে এত নিচে নেমে যায় যে আর দেখা যায় না। লালন নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে কলমির খিলখিল হাসি শোনা যায়। কলমি বলে উঠে, “এইতো তোমার শরীর জেগে উঠেছে। আমাকে শান্ত করো সাঁই। তুমি দেখছি ভাবের ঘরে চুরি করো সাই”। লালন স্থির গলায় বলে উঠে, “শরীর জাগে শরীরের নিয়মে, মন যদি না জাগে?” কলমি চলে যায়। আবার একজায়গায় দেখানো হয়, কলমি ঘরের চালে ঘর বাধার কাজে ব্যস্ত কালুয়ার দিকে ইঙ্গিত মূলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করার পর কালুয়া চাল থেকে নেমে পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে থাকে। নিজের হাতে বানানো ঘর নিজেই দা দিয়ে কোপাতে থাকে। সব দেখে শুনে লালন কলমিকে বলে, “কালুয়ার নারী সঙ্গ লাগে, আমি চাই তুমি ওর সেবা করো”। কলমি বলে, “সময় গেলে সাধন হবে না”। শেষে যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও লালনের নিদের্শে পালন করতে রাজী হয়ে যায় কলমি। আমি জানি না, কাল্পনিক চরিত্র দিয়ে এগুলো দেখানোর উদ্দেশ্য কী? কলমির চেয়ে লালন ফকিরের সহধর্মিনী এবং সাধনসঙ্গী বিশখা ফকিরানীকে দেখানো হলে কী খুব অসুবিধা হতো? বিশখা ফকিরানী সারাজীবন লালনের সাথে ছিলেন। মৃত্যুর পর তার কবর লালনের কবরের সাথেই দেওয়া হয়েছে। সেই বিশখা ফকিরানীকে কেনো আমরা ছবিতে দেখতে পেলাম না?

‘মনের মানুষে’ আরো দুইটি নারী চরিত্র দেখনো হয়েছে। একজনকে দেখা যায়, বিধবা হওয়ায় যাকে 'সতীদাহ' প্রথায় জীবন্ত পোড়ানো হচ্ছিলো। সেই নারীকে লালন ও তাঁর শিষ্যরা রক্ষা করে এবং 'আনন্দবাজারে' ঠাঁই দেয়। সেই নারী মানে ভানুমতিকে কলমি লালনের কাছে পাঠায় 'সেবা' করার জন্য এবং লালন আবার সাধনসঙ্গিনী করে দেন তাঁরই শিষ্য দুন্দু শাহ-এর। এক জায়গায় এই দুন্দু শাহের প্রশ্ন ইসলামে গান হারাম কী না, এর জবাবে “আকাশটা কাপছিল ক্যান ? জমিনটা নাচছিল ক্যান? বড়পীর ঘামছিল ক্যান, সেই দিন সেই দিন, গান গাইছিল খাজা যেই দিন” গানটি গেয়ে কী বোঝাতে চাইলো বুঝতে পারলাম না। আমি সঠিক জানি না, কোথায় যেনো পড়েছি, এই গানটি লালনের নয়, মাত্র ২০/২৫ বছর আগের লেখা! আরেকজন নারী চরিত্র হচ্ছেন সর্বক্ষেপী বোষ্টমী, যার নাম ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ব্রাহ্মণের দ্বারা এই নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলো কী না, তা কোথাও খুঁজে পাই নি।

ছবিটির এই পর্যায়ে তিনটি ঐতিহাসিক চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে। মনিরুদ্দিন শাহ, কাঙ্গাল হরিনাথ এবং মীর মশাররফ হোসেন। লালন জীবনে মনিরুদ্দিন শাহ খুবই গুরুত্বপূর্ন। লালন যখনই কোনো গান বাঁধতেন, মনিরুদ্দিন শাহকে ডাকতেন এবং গেয়ে শোনাতেন। মনিরুদ্দিন শাহ সেই গান শুনে লিখে রাখতেন। এখন পর্যন্ত লালনের যে সমস্ত গান পাওয়া গেছে তার বেশীর ভাগ কৃতিত্ব মনিরুদ্দিন শাহের। মাঝে মাঝে এই একই কাজ করতেন ফকির মানিক। কিন্তু ছবিতে ফকির মানিকের উপস্থিতি একেবারেই নেই আর মনিরুদ্দিন শাহকে রাখা হয়েছে অন্যান্যের মতো একজন সাধারণ বাউল বেশে। কেনো এটা করা হয়েছে, আমার ছোট মাথায় তা ধরেনি।

ছবিতে অসম্পূর্ণ দুই চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে কাঙ্গাল হরিনাথ আর মীর মশাররফ হোসেনকে। কাঙাল হরিনাথের জন্ম কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালিতে। তার আসল নাম হরিনাথ মজুমদার। ১৮৬০ সালের এপ্রিলে কাঙ্গাল হরিনাথ গ্রামবার্তা প্রকাশিকা নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকায় সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ, ছড়া ইত্যাদি প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি গ্রামবাংলার অত্যাচারিত কৃষক সমাজের দুঃখ দুর্দশার কথা বৃহত্তর জনসমাজে প্রচার করেন। গ্রামবার্তা পত্রিকায় হরিনাথ জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশের অপরাধে জমিদারেরা তাঁর ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। পত্রিকা অফিসে আক্রমন করার খবর ছেঁউড়িয়াতে পৌঁছলে লালন তার অনুসারীদের নিয়ে হরিনাথের বাড়ি পাহারা দেন। হরিনাথ মজুমদার একটি বাউলের দল করেছিলেন। তিনি গানও লিখতেন। লালনের সঙ্গে হরিনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। কাঙ্গাল হরিনাথের প্রেসে বসে লালন “এ যে দেখি কানার হাট-বাজার” গানটি রচনা করেন। অন্যদিকে কাঙ্গাল হরিনাথের অনেক গান বর্তমানে প্রচলিত থাকলেও তার নাম কাউকে উল্লেখ করতে দেখা যায় না। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি পথের পাঁচালীতে কাঙ্গাল হরিনাথের “হরি দিনতো গেল-সন্ধ্যা হল-পার কর আমারে” গানটি ইন্দির ঠাকুরনের ভূমিকায় চূনীবালা গেয়েছিলেন। কিন্তু রচয়িতা হিসাবে হরিনাথের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

বিষাদ সিন্ধু ও জমিদার দর্পণ-এর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্র কুমার রায়রা ছিলেন কাঙ্গাল হরিনাথের শিষ্যতুল্য এবং গ্রামবার্তার লেখক। মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন হরিনাথের বন্ধু ও গ্রামবার্তার সংবাদদাতা। কাঙ্গাল হরিনাথের কাছ থেকে মীর মশাররফ হোসেন গদ্য লেখা শিখে বিষাদ সিন্ধু রচনা করেন। এর সম্পাদনায় ছিলেন কাঙ্গাল হরিনাথ নিজে। লালনের মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘হিতকরী’-তে প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে "মহাত্মা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রচনার লেখকের নাম ছিলো রাইচরণ।

পুরোহিত আর মৌলভীদের একটা অংশে আমি খুব মজা পেয়েছি। যখন তারা একটা বাঁশের সাঁকোতে দাঁড়িয়ে লালনের বিরুদ্ধে শলা-পরামর্শ করছিলো, পুরোহিত বার বার বলছে, “ছায়া যাতে না পড়ে। এখন গঙ্গাজল পাই কোথায়?” পরে বাহাসের সময় মারামারির একপর্যায়ে দেখা গেছে পুরোহিত আর মৌলভীকে হাত ধরাধরি করে পুকুর পাড়ে যেতে।

ছবিতে দেখানো হয়েছে লালন ‘আনন্দবাজার’ নামে এক জায়গায় আস্তানা গেড়েছে। অথচ ইতিহাস বলে লালনের আখড়া ছিলো ছেউরিয়ায়। দেখানো হয়েছে, সিরাজ সাঁই শিষ্যসহ গঞ্জিকা সেবন করছে, এর মাজেযা বুঝতে পারলাম না। দেখানো হয়েছে, কাঙ্গাল হরিনাথের পরামর্শে লালন হাতে লাঠি তুলে নেয়, অথচ তাদের জীবিকা নির্ধারনের কোনো রাস্তা দেখানো হয়নি। আমি যতদূর জানি, লালনের শিষ্যরা পানের বরাজসহ বিভিন্ন কৃষিকাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। দেখানো হয়েছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লালনের আনন্দবাজারের খাজনা মওকুফ করে দেন, অথচ দেখানো হয় নি কীভাবে ঠাকুর বাড়ির জমিদারদের সাথে লালনের পরিচয় হলো।

ছবিটির নাম ‘মনের মানুষ’। বাউল ও লালন বিষয়ক পণ্ডিত অধ্যাপক উপেন্দ্রকিশোর ভট্টাচার্য বাউলদের 'মনের মানুষ' সম্পর্কে বলেনঃ

"মানব-দেহস্থিত পরমতত্ত্ব বা আত্মাকে বাউল 'মনের মানুষ' বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। আত্মাকে 'মানুষ' বলার তাৎপর্য মনে হয় এই যে, আত্মা মানবদেহকে অবলম্বন করিয়া বাস করিতেছেন ও মানবদেহের সাধনার দ্বারাই তিনি লভ্য এবং এই মানবাকৃতি তাঁহারই রূপ মনে করিয়া বাউল তাঁহাকে 'মানুষ' বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। এই মানুষ অলক্ষ্য অবস্থায় হূদয়ে বা মনে অবস্থান করিতেছেন, বোধহয় এই কল্পনা করিয়া তাহারা তাঁহাকে 'মনের মানুষ' বলিয়াছে। এই আত্মাকে তাহারা 'মানুষ', 'মনের মানুষ', 'সহজ মানুষ', 'অধর মানুষ', 'রসের মানুষ', 'ভাবের মানুষ', 'আলেখ মানুষ', 'সোনার মানুষ', 'সাঁই' প্রভৃতি নানা নামে অভিহিত করিয়াছে।"

এ প্রসঙ্গে লালন যা বলেন,

"এই মানুষে আছে, রে মন,
যারে বলে মানুষ রতন, লালন বলে পেয়ে সে ধন
পারলাম না রে চিনিতে।।"

মজার ব্যাপার হচ্ছে, গৌতম ঘোষের চলচ্চিত্র 'মনের মানুষ'-এ আমি এরকম কোনো মনের মানুষের সংজ্ঞাই পেলাম না, যা পেয়েছি তা হচ্ছে ঝাপসা এবং অসম্পূর্ণ।

ছবিটি দেখতে আমার খুব ভালো লেগেছে। এর দৃশ্যায়ন, ক্যামেরার কাজ, যদিও এগুলো সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না, মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। যে প্রাকৃ্তিক পরিবেশে শুটিং হয়েছে, মনে হয়েছে সেখানে হারিয়ে যাই। যুবক লালন হিসেবে জিশানের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি, মনে হয়েছি সত্যি সত্যি যুবক লালনকে দেখছি। সিরাজ সাঁইয়ের চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ, পদ্মাবতী হিসেবে গুলশান আরা চম্পা, কালুয়া চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরী, কবিরাজ হিসেবে হাসান ইমাম-প্রত্যেকের অভিনয় দেখে বাংলাদেশি হিসেবে গর্ববোধ করেছি। আবার কলমি চরিত্রে পাওলি দামের অভিনয় দেখে মনেই হয় নি এটা তার প্রথম কোনো চলচ্চিত্রে অভিনয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর হিসেবে প্রিয়াংশু চ্যাটার্জীকে ভালোই মানিয়ে গিয়েছে। আর পূর্ণবয়স্ক লালন চরিত্রে প্রসেনজিতের কথা বলার কিছুই নেই, যতই দিন যাচ্ছে এই প্রতিভাবান এবং জনপ্রিয় অভিনেতার অভিনয়গুণ যেনো আরো প্রস্ফুটিত হচ্ছে।

মনের মানুষে প্রচুর গান ব্যাবহার করা হয়েছে, সে অর্থে এটা একটি মিউজিক্যাল মুভিও বটে। এই ছবিটি দেখতে গিয়ে আমার বাংলাদেশের আরেকটি ছবি, প্রখ্যাত নাট্যকার মমতাজ উদ্দিনের পরিচালনায় ‘হাছন রাজা’র কথা মনে গেলো। দুইটি ছবিই প্রায় একই ধাঁচের, যদিও মেকিং-এ বিস্তর পার্থক্য আছে। আরেকটি কথা না বললেই নয়, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী চরিত্রে বিবি রাসেলের অভিনয় সপ্রতিভ না হলেও, তার চরিত্রগুলোর পোশাক ডিজাইন আমার কাছে ভালোই লেগেছে।

আসলে, মনের মানুষকে যদি আমি শুধুমাত্র চলচ্চিত্র হিসেবে দেখি, তাহলে আমার দেখা অসাধারণ এক চলচ্চিত্র, যে চলচ্চিত্র মন কে অনেকক্ষন ধরে আবেশ করে রাখে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে তখন মনের মানুষকে কাঠগড়াতে দাঁড়াতেই হবে।

সবশেষে একটি মজার তথ্য দিয়ে এই লেখা শেষ করতে চাচ্ছি। ছবিটির একদম শেষে দেখা যায়, গগন হরকরা নামে এক যুবক লালনকে “আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে”-গানটি শুনাচ্ছে। গগন হরকরা ছিলেন বিশিষ্ট বাউল গীতিকার। জন্ম হয়েছিলো শিলাইদহের নিকটস্থ আড়পাড়া গ্রামে। পেশা ছিল শিলাইদহ ডাকঘরে চিঠি বিলি করা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা” গানটি রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার গাওয়া এই গানটিরই সুর ভেঙে রচনা করেন। সরলা দেবী চৌধুরাণী তাঁর ‘শতগান’ গ্রন্থে উভয় গানের স্বরলিপিই প্রকাশ করেন।

“আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে –
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগৎ সুখী
হেরিলে জুড়ায় আঁখি সামান্যে কি দেখিতে পারে
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে।
মরি হায় হায় রে –
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষ্যে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে –
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে
মরি হায় হায় রে –
ও সে মানুষের উদ্দেশ যদি জানিস কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে ব্যথায় ব্যথিত হয়ে
আমায় বলে দে রে”।

No comments:

Post a Comment