বেশরা ফকির লালন সাঁইকে নিয়ে ভদ্দরলোকদের সূক্ষ্ম প্রেমের মর্ম বোঝা ভার!!



গৌতম ঘোষের মনের মানুষ (২০১০) সিনেমা নিয়ে আলাপ তুলবার আগে এর শানে নুযুল একটু বিশদ করা প্রয়োজন। সিনেমাটি তৈরি হয়েছে কলকাতার যশবান কবি-ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মনের মানুষ উপন্যাস অবলম্বনে। উপন্যাসটির ভিতর ফ্ল্যাপে কাহিনী-সংক্ষেপ ছাপা হয়েছে এভাবে:

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘মনের মানুষ’-এর প্রধান চরিত্র লালন ফকির। কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন সেনের ঘোড়া চুরি করে রাতে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগত লালুর। দুঃখিনী মা তাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েও সংসারী করতে পারেননি। রুজি-রোজগারে লালুর মন নেই, বরং গানের ব্যাপারে তার কিছু আগ্রহ আছে। বাউন্ডুলে স্বভাবের লালুর জীবনে বিপর্যয় এল হঠাৎ। কবিরাজ পরিবারের সঙ্গে বহরমপুরে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল সে। পথে আক্রান্ত হয় ভয়ঙ্কর বসন্ত রোগে। তাকে মৃত ভেবে জলে ভাসিয়ে দেয় সঙ্গীরা। মরেনি লালু। রাবেয়ার পরিচর্যায় সুস্থ হয়ে সে একদিন ঘরেও ফেরে। কিন্তু মুসলিম-সংস্পর্শে তার যে জাত গেছে! তাকে মেনে নেয় না তার মা, বউ। অগত্যা সমাজ থেকে বিতাড়িত যুবকের নতুন জীবন শুরু হয় জঙ্গলে। নতুন নাম হয় লালন। অভিজ্ঞতা আর বেদনা লালনের অন্তরে জন্ম দেয় শত শত গান, যে গান বলে- ‘ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারী লোকের কী হয় বিধান/বামন চিনি পৈতে প্রমাণ/বামনী চিনি কীসে রে…’। লালন বাঙালির প্রাণের ধন, পথে পথে যিনি আজীবন খুঁজেছেন ‘মানুষ-রতন’। [নজরটান আমার]

মনের মানুষ সিনেমার পোস্টার

লেখকের বক্তব্যে সুনীল বলে দিয়েছেন: ‘‘এই উপন্যাসটি লালন ফকিরের প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক জীবনকাহিনি হিসেবে একেবারেই গণ্য করা যাবে না। কারণ তাঁর জীবনের ইতিহাস ও তথ্য খুব সামান্যই পাওয়া যায়।’’[২] তাই আমরা ধরে নিতে পারি যে লালনের নামে প্রচলিত নানা কাহিনীর মতো এটাও যে-কোনো একটা কাহিনী; এবং ঐতিহাসিক তথ্যর ‘সত্যতা’ কোন মানদণ্ডে নির্ধারিত হয় তার ফয়সালা আপাতত তুলে রাখতে পারি। যদিও, পরের বাক্যে তিনি একটা দোহাই পেরেছেন যে এর কারণ হলো: ‘‘লালনের জীবনের ইতিহাস ও তথ্য খুব সামান্যই পাওয়া যায়’’। আমরা যে কেউ একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবো, পুরো বাংলায় ‘গৌণধর্ম’গুলোর ভিতরে সাম্প্রতিক একশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত ও চর্চিত চরিত্র হলো ফকির লালন সাঁই। সুতরাং, চাইলে লালনের সাধকজীবনের ‘ঐতিহাসিক’ একটা কাহিনী লেখাও অসম্ভব হতো না। ইতিহাসকে উর্ধ্বকমার ভিতরে বন্দি করেছি কারণ, ইতিহাস বলে কোনো সায়েন্টিফিক সত্য নাই। ইতিহাসের লেখকও একটা সময়ের নির্মাণ। তার হাত দিয়ে যে ইতিহাস লিখিত হয় তা পরিস্থিতি বা ঘটনা/ঘটনাবলীর একটামাত্র ভাষ্য—একটা কাহিনী। যাহোক, সুনীলের বক্তব্য এটুকু অন্তত নিশ্চিত করছে যে, তিনি নির্ভরযোগ্য ও যাচাইকৃত ঐতিহাসিক তথ্যনির্ভর উপন্যাস না লিখে একটা কাহিনী ফেঁদেছেন। তাই, ঐতিহাসিক ‘সত্যতা’ কতোটুকু এই উপন্যাসে আছে তা নয়, এবং এ কাহিনী ইতিহাসনির্ভর হোক বা না হোক, এ সময়ে লালন জীবনের এই কাহিনী কী তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয় তা আমাদের প্রধান বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠে।

সুনীল আরেকটা বিবৃতি দিয়েছেন লেখকের কথায়: ‘‘লালন ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু কোনোও বিশেষ ধর্মের রীতিনীতি পালনে আগ্রহী ছিলেন না। সব ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন জীবনে।’’[৩] ‘ধার্মিক’ ও ‘মানবতা’ শব্দ দিয়ে তিনি আধুনিক মানবতাবাদের ‘ভাবকল্প’ লালনের কাঁধে তুলে দেন। কিন্তু এর ভিত্তিই বা কী! বস্ত্তত সব কাহিনীতেই কাহিনীকারের ‘আমি’ থাকে। ফলে লেখক নিজস্ব চরিত মানবতাবাদের চাদরেই মুড়ে নেন লালনকে। তার ‘আধুনিক’ ‘মানবতাবাদী’ মনের চোখে লালনের ইমেজ দাঁড়ায় এরকম: বসন্ত-আক্রান্ত পরিত্যাক্ত লালু মুসলমান নারীর হাতে অন্ন গ্রহণের কারণে হিন্দু-সমাজ পরিত্যক্ত হয়। তাকে মেনে নেয় না তার মা, বউ। অগত্যা সমাজ থেকে বিতাড়িত যুবকের নতুন জীবন শুরু হয় জঙ্গলে। নতুন নাম হয় লালন। অভিজ্ঞতা আর বেদনা লালনের অন্তরে জন্ম দেয় শত শত গান, যে গান বলে- ‘ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান/নারী লোকের কী হয় বিধান/বামন চিনি পৈতে প্রমাণ/বামনী চিনি কীসে রে…’। এ যেন জাত যাওয়ার একটা কাহিনীর ‘কেশের আড়ে’ শৈব-সহজিয়া-বৈষ্ণব-সুফি ধারার সম্মিলনে গড়ে ওঠা উজ্জ্বলতম এক পন্থার দিশারী দরবেশ ফকির লালনের পুরো সাধকজীবনের ‘পাহাড় লুকায়’। আর এই লুকোচুরিতেই লালন হয়ে ওঠেন বাঙালির প্রাণের ধন, পথে পথে যিনি আজীবন খুঁজেছেন ‘মানুষ-রতন’।

কিন্তু ধন্ধ লাগে উপন্যাসটির পেছন মলাটে তাকালে। কৃষক চৈতন্য ও নিম্নবর্গের স্বরের ইতিহাস রচনা করে এবং সাবলটার্ন স্টাডিজ নামে ভারতীয় ইতিহাস অধ্যয়নের এক নতুন ধারার প্রবর্তনা করে জগত-বিখ্যাত হয়েছেন পণ্ডিত রণজিৎ গুহ। প্রচলিত ইতিহাস রচনার খোলনলচে বদলে দিয়েছে তাঁর ভাবনাগুলো। ইতিহাস পাঠে নতুন নজরদৃষ্টি দানের জন্য তাঁর কাছে আমাদের ঋণ অসীম। তাঁর একটা ছোট্ট মূল্যায়ন ছাপা হয়েছে মনের মানুষ[৪] উপন্যাসের পেছন-মলাটে। তিনি বলছেন ‘‘তথ্যগত ভিত্তি সংকীর্ণ হলেও একটা ঐতিহাসিক কাহিনীর ঐতিহাসিকতা কী করে বজায় রাখা যায় সেই দুঃসাহসিক চেষ্টার সাফল্য এ উপন্যাসে সত্যিই বিস্ময়কর।’’ লালনকে নিয়ে ‘ইতিহাসরূপ’ কল্পকাহিনী কতোদূর বিস্তৃত হয়েছে তা এই মন্তব্য থেকেই অনুমান করা যায়। লেখক যদিও বলেছেন এটাকে লালনের ‘প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক জীবনকাহিনি হিসেবে একেবারেই গণ্য করা যাবে না’, তার বিপরীত কথা বলেন রণজিৎ গুহ। তাহলে প্রশ্ন জাগে, উপন্যাসবর্ণিত কাহিনীর ঐতিহাসিকতার প্রমাণপত্র কেন ছাপা হলো, লেখকের বক্তব্যর সাথে এর সাযুয্য কোথায়? গুহর কথাগুলোকেও তো আমরা ফেলে দিতে পারি না! আমরা সুনীলের উপন্যাসটিকে কীভাবে পাঠ করবো তাহলে: শুধুই একটা কাহিনী, নাকি ইতিহাস? নাকি, নির্মিয়মান ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গড়ে তোলা কাহিনী! সুনীলের লেখা কল্পকাহিনীটি ‘ইতিহাস’ রূপে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই কি গুহর সার্টিফিকেট ছাপা হয়েছে? উপন্যাসটির শেষ পৃষ্ঠায় রণজিৎ গুহর উদ্ধৃতিটুকু পড়ে এই প্রতীতিই দৃঢ় হয় যে বাংলার আগামী ইতিহাস নির্মাণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই কাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। লালন হবেন একটা ‘আইকন’- যার ধর্ম হলো ‘মানবতাবাদ’।

আর, এই প্রকার মানবতাবাদের টানেই গৌতম ঘোষ বানিয়েছেন ‘মনের মানুষ’ সিনেমাটি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে। বাঙালি জাতির ইতিহাস গঠনের প্রশ্নে এই চলচ্চিত্রটি পাঠ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। জরুরি কেননা, ০৩-১২-২০১০ তারিখে দুই বাংলায় একইসাথে ১০০টি পেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় মনের মানুষ চলচ্চিত্রটি। যতোদূর জানা যায়, এর আগে যৌথ প্রযোজনায় বাংলাদেশে আরো অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও কখনোই কোনো চলচ্চিত্র একসঙ্গে দুই দেশে মুক্তি পায়নি।[৫] আর, মুক্তি পাওয়ার আগেই ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত ৪১তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘গোল্ডেন পিকক’ পায়। গত দশ বছরের মধ্যে আর কোনো ভারতীয় চলচ্চিত্র এ পুরস্কার পায়নি। ‘‘বিস্ময়কর চালিচ্চিত্রিক সৌন্দর্য এবং ঘৃণা-ক্লেদে পূর্ণ আজকের পৃথিবীতে ভালোবাসার আন্তরিক চিত্রায়ণের জন্য’’[৬] মনের মানুষকে এই পুরস্কার দেয়া হয়। ছবি মুক্তির দু’দিন পরে ঢাকায় ছবিটি নিয়ে প্রচারণায় এসে গৌতম ঘোষ সংবাদ সম্মেলনে ‘মনে করিয়ে’ দেন যে ‘মনের মানুষ লালন বিষয়ক চলচ্চিত্র, লালন জীবনী বিষয়ক নয়। আর লালন মানে একটি দর্শন যা সহনশীলতার শিক্ষা দেয়।’’[৭] ২৩ ডিসেম্বর ২০১০ বিবিসি বাংলা সার্ভিসের সাথে সাক্ষাৎকারে[৮] এই ছবি নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিগত শতাব্দীর নব্বই দশক থেকেই এই সিনেমা বানাবার পরিকল্পনা ছিল তার। ‘‘নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হলো তখনই আমার মনে হয়েছে একটা ছবি বানাবো লালনকে নিয়ে। কারণ বিশ্বজুড়ে ধর্মীয়, রাজনৈতিক যে অসহিষ্ণুতা তৈরি হচ্ছে তার বিপক্ষে দাঁড়ানোর শক্তি কেবল লালনেরই আছে।’’

বুঝা যাচ্ছে, মনের মানুষ এ সময়ের একটা তাৎপর্যপূর্ণ সিনেমা। এ সিনেমা ক্লেদপুর্ণ দুনিয়ায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেবে, হিন্দু মুসলমানের ঐক্যেরও পথ করে দেবে। একইসাথে, এ সিনেমা দুই বাংলার রক্তাক্ত ইতিহাস পুনর্লিখনেও নিযুক্ত। যে-কারণে লোকরঞ্জন সংস্কৃতির মুখপাত্ররা এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ওপারের বাংলাবাজার পত্রিকায় সমরেশ মজুমদার তার প্রতিক্রিয়া লিখেছেন ‘‘মনের মানুষ: তবু যা পাওয়া গেল চুমুক দিয়ে খাবার পরেও আলোড়িত থাকার মতো’’ শিরোনামে[৯]। তিনি এতোই আলোড়িত হয়েছিলেন যে বলেন: ‘‘শুধু ছবি বললে কম বলা হবে। আমি এক মহাজীবন প্রত্যক্ষ করলাম। বাংলা ভাষার যাবতীয় বিশেষণগুলো মিইয়ে যাচ্ছে।’’ আর, এদেশের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর সাথে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন: ‘‘আমি স্নাত’’!! আভিজাত্যবাদী ও তথাকথিত সেক্যুলারবাদীরা বাংলার এমন এক ইতিহাস কল্পনা করেন যেখানে লালনের এই নির্মাণই প্রত্যাশিত। ফলত তারা স্বভাবতই এ সিনেমা দেখে আনন্দে ডগমগ হবেন। যদিও, ফকির লালন সাঁই ও তার শিষ্যরা কেন ভদ্দরলোকদের থেকে দূরে থাকতেন সেটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও গৌতম ঘোষের মনের মানুষ পড়ে ও দেখে আন্দাজ করতে অসুবিধা হয় না। ফকিরদের অজাত-কুজাত বলে গালি দেয়া বা নিতান্ত অবহেলায় অগ্রাহ্য করাটাই চল, আর যখন তাদের ঘরে তোলা হয় তখন ধোলাইমোছাই করে নিজেদের মতাদর্শের মাপে কেটে-ছেঁটে এমন এক আকৃতি দেয়া হয় যে ফকির নিজেও তার অবয়ব চিনতে পারে না। একালের সুনীল-গৌতম লালনের এমন এক অবয়বই খাড়া করেন।

মনের মানুষ, চিত্র ১: কমলি ঠাইরেন লালনের শরীর জাগানোর চেষ্টায় রত

তবে, লালন নিয়ে যারা একটু খোঁজখবর রাখেন তারা কিন্তু কোনো মহাজীবনের ছাপ সিনেমাটিতে দেখতে পাচ্ছেন না। তাই, বাংলাদেশে, যথাযথ কারণেই, গৌতম ঘোষের মনের মানুষ নিয়ে একটা অসন্তোষ ও প্রতিবাদ দানা বেঁধে উঠেছে। লালন গবেষক, আলোচক, পর্যবেক্ষক, ভক্তরা মনের মানুষকে কীভাবে গ্রহণ করছেন এবং তাদের মূল্যায়ন কি–এ বিষয় নিয়ে বিডিনিউজ২৪ ডট কম ২৮ জানুয়ারি ২০১১ এক সেমিনারের আয়োজন করে। আর্টস সম্পাদক ব্রাত্য রাইসুর সঞ্চালনায় আলোচনা হয় এবং লাইভ ব্লগিং-এর মাধ্যমে আলোচনার চুম্বক অংশ পাঠকের সামনে তুলে ধরা হয়। যে লালনকে নির্মাণ করা হয়েছে সিনেমাটিতে তা, ফরহাদ মজহারের জবানে, এক ধরনের ‘পারভার্সন’। কেননা, ‘‘মনে হচ্ছে লালন যেন আনন্দবাজারে একটা ব্রোথেল পরিচালনা করে’’। তাই তিনি দাবি করেন, ‘‘এই ছবিতে লালনকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে।’’ অর্থাৎ, লালনের যে ইমেজ আমাদের মনে আসে তা একেবারেই নির্মিত হয়নি মনের মানুষ সিনেমায়, মহাজীবন তো কোন দূরের কথা। দ্বিতীয় যে অভিযোগটি স্পষ্ট করে বলেছেন আলোচকেরা, যেমন অরূপ রাহী বলেন, ‘‘এটা কালচার ইন্ডাস্ট্রির একটা প্রেডাক্ট ছাড়া আর কিছুই না।’’ সলিমুল্লাহ খান, ফাহমিদুল হক, মানস চৌধুরীসহ আরও অনেকে সহমত হন এই বক্তব্যের সাথে। মানস চৌধুরী বলেন, ‘‘এই ছবিতে মিস্টি প্রেমের গল্প আছে। ডিসলোকেশন আছে। মধ্যবিত্তীয় পছন্দের ফোক-ফ্যান্টাসি নির্ভর নানা উপকরণে সমৃদ্ধ। মোটকথা, এর ভিতরে জনপ্রিয়তার উপকরণগুলো আছে।’’ সলিমুল্লাহ খান তৃতীয় অভিযোগটা তুলেছেন: ‘‘অভিজাতের দৃষ্টিতে লালনকে দেখাই হচ্ছে এই ছবির প্রধান প্রতিপাদ্য। মনে হয়েছে রাতভর তিনি ঠাকুরকে তার কাহিনী শুনিয়েছেন খাজনা মওকুফের জন্য। সকালবেলা খাজনা মওকুফের ঘোষণা শুনে তার অভিব্যক্তি যেন সেটাই তুলে ধরে।’’ এই অভিযোগগুলোর পাশাপাশি রাহী যুক্ত করেন: ‘‘তবে এর রিপ্রেজেন্টেশনাল রাজনীতিটা বুঝতে হবে।’’ অবশ্য সেই রাজনীতিটা তিনি খোলসা করেন নি, অন্য আলোচকদেরকেও দেখি না খোলসা করতে। কল্লোল মুস্তফা ‘গৌতম ঘোষের ‘‘মনের মানুষ’’: জাতহীনের জাত মারার তরিকা’’[১০] প্রবন্ধেও বস্ত্তত এই অভিযোগগুলোই তুলেছেন। কয়েকটি দৃশ্য আলোচনা করে কল্লোল মন্তব্য করেছেন: ছবিটিতে নারী পুরুষের সম্পর্ককে ‘ভাব জেনে প্রেম করা’, ‘কামী থেকে নিষ্কামী হয়ে উঠা’ কিংবা ‘কামের ঘরে কপাট মারা’র সাধনার অংশ হিসেবে দেখি না, দেখি কামোন্মত্ত নারী-পুরুষের কাম নিবৃত্ত করার উপায় হিসেবে, লালন কিংবা সিরাজ সাঁইয়ের ভূমিকা যেখানে গুরুর নয়, দালালের।’’ দ্বিতীয় যে আপত্তির জায়গা কল্লোল শনাক্ত করেছেন তা হলো: ভদ্রলোক পরিচালক গৌতম ঘোষ লালন ও তার সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষের যৌনতা বিষয়ে যতটুকু আগ্রহ দেখিয়েছেন তার এক শতাংশ আগ্রহও দেখাননি তার সামাজিক ও যৌথ জীবনের অন্যান্য অনুষঙ্গে। আবার যতটুকু এনেছেন, সেটাকে এনেছেন ছাড়া ছাড়া ভাবে খণ্ডিত, খর্বিত, সরলীকৃত ও বিকৃত রূপে।’’ তার তৃতীয় অভিযোগটি এরকম: ‘‘গোটা ছবিতে দেখা যায় লালন সম্প্রদায়ের প্রধান শত্রু হলো মোল্লা আর পুরুত মশাইরা আর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলো জমিদার। অথচ মোল্লা পুরুতের পাশাপাশি বাংলার মানুষের ওর‌্যাল ন্যারেটিভ বা কথ্য ইতিহাসের মধ্যে জমিদারতন্ত্রের সাথে লালন সম্প্রদায়ের রীতিমতো লাঠালাঠির ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়।’’ অবশ্য এই তৃতীয় অভিযোগটি সুনীল-এর উপন্যাসটি সম্পর্কে খাটে না। যদিও ঠাকুরবাড়ি সেখানে অনিবার্য অনুষঙ্গ, তবু কাহিনী বলার জন্য জমিদারের বজরায় লালনকে বসিয়ে ফ্লাশ-ব্যাক এ গল্প বলানো হচ্ছে না। বরং এরকম একটা ঘটনার বিবরণ আছে যে জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়িতে হামলা করতে এলে লালন ও তার সঙ্গীরা লাঠি হাতে এসে তা প্রতিরোধ করেন। কল্লোল তার লেখার মন্তব্যগুলো ধরে সামহোয়ার ইন ব্লগ-এ আরও কিছু মন্তব্য করেছেন: ‘‘ছবির মূল ধান্দা বাণিজ্য; লালন দর্শন, লালন জীবন এইসব উপলক্ষ্যে মাত্র/লালন এখন বেশ নামী ব্রান্ড… [এটাকে] সাংস্কৃতিক-বাণিজ্যিক প্রকল্পের একটা মহড়া বলা যেতে পারে।’’

যাহোক, এই ‘খণ্ডিত’ ‘বিকৃত’ নির্মাণের প্রতিবাদ করে কল্লোল বলেন: ‘‘ছবির পরিচালক গৌতম ঘোষ কিংবা বাংলাদেশের প্রযোজনা সংস্থা ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও আশির্বাদ চলচ্চিত্র এবং ভারতীয় প্রযোজনা সংস্থা রোজভ্যালি কিংবা বাংলাদেশের কর্পোরেট নিবেদক বাংলালিংক এলিট শ্রেণীর কোনো মহানায়ক বা জাতীয় বীরকে নিয়ে এ ধরনের স্বেচ্ছাচার করার স্পর্ধা দেখাতো না, লালন নিম্নবর্গের নায়ক কিংবা জাতহীন বলেই, তাকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করা যায় কিংবা করানোও যায়। আর লালনকে নিয়ে এই যা ইচ্ছে তাই করা ও করানো এবং সেটাকে লালন দর্শন বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টাকে সাংস্কৃতিক জমিনের উপর চলমান কর্পোরেট, বহুজাতিক ও বিজাতীয় আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের নমুনা হিসেবেই দেখতে হবে এবং মোকাবিলা করতে হবে।’’

এই সমালোচনাগুলো নিশ্চিতভাবেই করা যায় সিনেমাটির বিরুদ্ধে এবং এর একটিও খারিজ করতে পারবেন না নির্মাতাগণ। লালন সম্পর্কে আমাদের যে জানাশোনা ও উপলব্ধি তার প্রতিফলন নেই সিনেমায়- এটাই সমালোচনাগুলোর ভিত্তি, একটা ‘অথেনটিক’ লালন চরিত্রের আকাঙ্ক্ষা এসব সমালোচনার ভিত তৈরি করে দেয়। তবে এ সমালোচনাগুলো স্পষ্ট করে তোলে না কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায় এরকম একটা কাহিনী, কেনই বা এইভাবে কাহিনীটি নির্মিত হয়েছে, কেবলই কি সাংস্কৃতিক বাণিজ্যের ধান্ধা? এরকম রেপ্রিজেন্টেশনের রাজনীতিটা কোথায়? ‘অথেনটিক’ লালন নির্মাণে কতোটুকু ঘাটতি থেকে গেল সেই মাপজোখ করার বদলে আমাদের জন্য জরুরি হয়ে ওঠে বিচার করা, লালনকে নিয়ে এই আইকন নির্মাণ প্রকল্প কোন গাঙ বেয়ে চলেছে।



মনের মানুষ সিনেমায় আলো-আঁধারীর খেলা আছে, আছে লালনকে নিয়ে সাজানো কিছু ইমেজের উপস্থিতি, এবং প্রকৃত কিছু ইমেজের অনুপস্থিতি। এর ফলে, লালন যে প্রতিস্পর্ধী এক দার্শনিক-সামাজিক-রাজনৈতিক সাধনার অবস্থান নিয়েছিলেন, কিম্বা যেভাবে সামাজিক, ধর্মীয়, জাতিগত ক্ষমতাতন্ত্রকে অস্বীকার করেছিলেন তা হারিয়ে যায় এবং উপস্থিতি-অনুপস্থিতির খেলায় নির্মিত হয়ে ওঠে এক ঋষি লালন–যে কিনা হিন্দু-মুসলমানের মিলন প্রত্যাশী। বলা যায়, গৌতম ঘোষের লালনকে নির্মাণ করা হয়েছে ভারতীয় ‘হিন্দু’ মুনিঋষিদের অনুকরণে, মুসলিম ধারার সুফি-দরবেশদের অনুকরণে নয়। অথচ লালন, ‘‘বাহ্যতঃ মুসলমান ফকিরবৎ আচরণ করিলেও খুব সম্ভবত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নাই…’’।[১১] অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়ের জাতি নির্ধারণী উৎকণ্ঠিত অনুমান ‘‘খুব সম্ভবত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নাই’’-এর তাৎপর্যবিচার আপাতত পাশে সরিয়ে রেখে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে যে লালন ‘মুসলমান ফকিরবৎ’ আচরণ করতেন এবং তাঁর গানে কোরআন ও ইসলামী ভাবধারার নজির সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। তথাপি, ফকির লালনকে সেরকম কোনো আচরণ করতে মনের মানুষ সিনেমায় আমরা দেখি না। গবেষক শক্তিনাথ ঝা শান্তিনিকেতন থেকে লালনের নির্ভরযোগ্য যে গানের খাতাটি উদ্ধার করেন এবং প্রথম পৃষ্ঠার ছবি ছাপেন, সেখানে বলা হচ্ছে: ‘‘শ্রী লালন শাহ দরবেসের তালেব শ্রী ভোলাই শা ফকির এই বহির মালিক’’।[১২] ‘দরবেস’ শব্দটির ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আরও কিছু তথ্যর দিকে আমরা নজর দিতে পারি। শক্তিনাথ ঝা বলেন, ‘‘মুসলমান জোলাগোষ্ঠী ছিল লালনের আত্মীয় এবং মূল আশ্রয়। অবিভক্ত নদীয়ার ছেউড়িয়ায় তিনি নানা জনকে নিয়ে এক নতুন পরিবার গঠন করেছিলেন।’’[১৩] তাছাড়া, ‘‘লালনের নামে প্রচলিত গানে কোথাও নিজেকে তিনি বাউল বলেননি। সাঁই, দরবেশ বলেছেন গুরুকে; নিজের পরিচয় ফকির; মত ও সাধনপন্থা ফকিরী, সহজ, রসসাধনা। লালনের শিষ্যরা গুরুকে সাঁই, দরবেশ বলেছেন।’’[১৪] লালনের মৃত্যুর পরে পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকার প্রথম প্রতিবেদন, লালনের মৃত্যুর কিছুকাল পরে জলধর সেন, কিংবা উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যও তাঁকে ফকির হিসেবেই শনাক্ত করেছেন। উপেন্দ্রনাথের এই বাক্যটি প্রণিধানযোগ্য: ‘‘লালন ও বহুসংখ্যক ঐ মতাবলম্বী ফকির এবং গোঁসাই গোপাল ও অন্যান্য বহু বাউলপন্থী রসিক বৈষ্ণবের বাস ও লীলাস্থল এই কুষ্টিয়া অঞ্চল।’’[১৫] এই বাক্য থেকেও পরিষ্কার হয়ে ওঠে কুষ্টিয়া অঞ্চল লালনের সমসাময়িক কালে বাউলপন্থী সাধকদেরও উর্বর বিচরণ ক্ষেত্র ছিল এবং লালন নিজেকে সেই গোষ্ঠীভুক্ত করেননি। নদীয়ার জনসমাজে লালন ও তার অনুসারীদের বলা হতো ‘নেড়ার ফকির’ বা ‘বেশরা ফকির’।[১৬]

যে প্রশ্নটা করা দরকার তা হলো, বাউল পরিচয়ের বর্গে ফকির লালন শাহ/সাঁইকে চিহ্নিত করবার ইতিহাস কী, সে ইতিহাস জাতিসত্তার রাজনীতি ও জাতীয় সাংস্কৃতিক কল্পনায় কীভাবে অংশ নেয়? লালন স্বয়ং নিজেকে বাউল মনে করতেন না, নিজেকে বাউল বলে পরিচয়ও দিতেন না। একইসাথে, ফকির পরিচয় ব্যবহার করতে লালনের বা তার অনুসারীদের কোনো দ্বিধা ও কার্পণ্য করতেও দেখা যায় না। অনেক গানেই পদকর্তা হিসেবে স্বতঃসিদ্ধভাবে ব্যবহৃত লালন নামটির সাথে ‘ফকির’ ও ‘ফকিরি’ প্রত্যয় দুটি পওয়া যায়, ’বাউল’ প্রত্যয়টি কখনোই পাওয়া যায় না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের একজন বিখ্যাত পদকর্তা সাধক আব্দুল করিম শাহকে দেখি নিজের নামের সাথে বাউল প্রত্যয়টি হামেশা ব্যবহার করতে এবং ‘ফকির’ বা ‘ফকিরি’ প্রত্যয় দুটি এড়িয়ে চলতে। তিনি ‘ফকিরি’ সাধনায় যুক্ত নয় বলেই কি এটা ঘটে? এই পার্থক্যটুকু খুব সামান্য মনে হলেও, বাংলাদেশের ধর্ম ও রাজনীতির প্রতিসরণগুলো বুঝতে খুবই মূল্যবান পর্যবেক্ষণের বিষয় বলে মনে হয়। আব্দুল করিম শাহর গানে সাবলীলভাবে ‘বাউল’ পরিচয় ব্যবহারের ব্যাখ্যা কি আমরা ফকির লালন শাহের ‘বাউল সম্রাট’ হয়ে উঠবার ইতিহাসের মধ্যে খুঁজবো? আমরা অনুমান করতে পারি যে ‘ফকির’ পরাজিত শব্দ, এই পরিচয়বাচক শব্দটিকে সাধক পদকর্তার জবান থেকে এবং আমাদের মনোজগত থেকে হটিয়ে দিয়েছে পরিচয়বাচক ‘বাউল’ শব্দটি, যে-কারণে সাম্প্রতিক কালের সাধক আব্দুল করিম নিজের নামের সাথে ‘ফকির’ প্রত্যয়টি ব্যবহার না করে ‘বাউল’ পরিচয়টি ব্যবহার করেন। সুধীর চক্রবর্তী মনে করেন, ‘‘লালন পরবর্তী মৌলানা-মৌলবী এবং নৈষ্ঠিক হিন্দুবর্গ তাঁকে বাউল শ্রেণীভুক্ত করেছেন। তার একটা বড় কারণ হল, দুই বাংলার বাউল-ফকিররা লালনের গান সবচেয়ে বেশি গেয়ে থাকেন এবং তাঁর গানে নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠা করবার মতো অনেক যুক্তি ও তত্ত্বের ভিত্তি খুঁজে পান।’’[১৭] আর শক্তিনাথ ঝা মনে করেন, ‘‘আচার-ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িক সীমানা লঙ্ঘনকারী ফকির-দরবেশগোষ্ঠীতে কালক্রমে শিষ্টদের অবজ্ঞাবাচক ও সাধকদের প্রতিবাদবাচক বাউল শব্দ গৃহীত হয়েছিল। লালনের জীবদ্দশায় সূচিত হয়েছিল বাউল, ন্যাড়ার ফকির-বিরোধী আন্দোলন। ফলত বাউল শব্দটি স্পষ্টতা লাভ করেছিল।’’[১৮] আমার মতে, এর সাথে যুক্ত করতে হবে গত অর্ধ শতকের ভদ্দরলোকী রাজনীতি, যা দরবেশ ফকিরি ধারার সাধককে টেনে নেয় বাউল বর্গে। এ বর্গে টেনে নেবার একটা প্রধান প্রণোদনা এসেছিল ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের পরে, যখন লালনকে সুফি সাধক হিসেবে ইসলামী সাংস্কৃতিক বলয়ে আত্মীকরণের একটা প্রবল প্রচেষ্টা দেখা দিয়েছিল পূর্ব-পাকিস্তানে। বাংলাদেশের সেকুল্যারপন্থীরা দরবেশ ও ফকিরি তন্ত্র থেকে বিযুক্ত করে লালনকে ‘বাউল বর্গে’ প্রতিষ্ঠা করে ইসলামীকরণের হাত থেকে বাঁচানো গেছে বলে স্বস্তি বোধ করেছিলেন। এখনও করেন, যে-কারণে একালের খ্যাতিমান অধ্যাপক আনিসুজ্জামান মনের মানুষ দেখে নিশ্চিন্ত মনে ‘স্নাত’ হতে পারেন। কিন্তু সাপের ঘরেই তো ঘোগের বাসা থাকে! ‘বাউল’ বর্গে লালনকে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে যে গলদ ছিল তার নালা বেয়েই লালনের জন্মবৃত্তান্ত ও জাত-পাত খোয়ানোর কাহিনী পল্লবিত হয়ে ওঠে। আর এখন সেই বাউল বর্গ থেকে তাঁকে টেনে নেয়া হচ্ছে হিন্দু ঋষির জগতে।

আমার বলার কথা এই যে, ফকির ও দরবেশ হিসেবে লালনকে শনাক্ত করা সম্ভব হলেও ‘বাউল’ হিসেবে শনাক্ত করা যায় না, ‘হিন্দু’ বাউল তো নয়ই। এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে, লালন ছেঁউড়িয়ার মলম শাহের দেয়া চার একর জমির উপর আখড়া গড়ে সাধনা করেন। তথাপি, তিনি নিজেকে মুসলমান পরিচয়ে পরিচিত করা থেকে সযতনে বিরত থেকেছেন, হিন্দু পরিচয়েও নয়। কারণ, হিন্দু মুসলমান কোনো জাতের বর্গে তিনি অবস্থান করতে চাননি। অত্যন্ত সফলভাবে তিনি নিজের ও তাঁর সাধনসঙ্গী বিশোকার জাতপরিচয় গোপন করতে সক্ষম হন। ছেঁউড়িয়ায় কোথা থেকে এসেছিলেন, কী বিত্তান্ত সবই তিনি গোপন করেছিলেন- যা ফকিরি সাধনারই অংশ। ছেঁউড়িয়া-পূর্ব জনমের সব কাহিনীই কল্পিত, মনগড়া, উদ্দেশ্যমূলক।

কিন্তু এ উপমহাদেশে জাতিসত্তার রাজনীতি যখন হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সীমানা সংহতকরণে প্রবল হলো গত শতকের বিশের দশক থেকে, সে সময় লালনের জাত-পরিচয় নির্ধারণ করাটাও যেন লালন গবেষকদের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। এ নিয়েই ভদ্দরলোকদের কাড়াকাড়ি লাঠালাঠি প্রকটিত হয়, লালনের জীবন ধর্ম-রাজনীতির লড়াইয়ের ময়দান হয়ে ওঠে। ফলে কল্পনার জাল শতমুখে বিস্তৃত হতে লাগলো। লালনকে নিয়ে জাতিসত্তার রাজনীতির তিনটা সুস্পষ্ট প্রতিসরণ দেখা যায় গত শতকের বিশের দশক থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত। সে আলোচনায় এখানে যাবো না, বরং এটুকুই আমরা দেখব যে গৌতমের মনের মানুষও এই রাজনীতিতে অংশ নেয় এবং লালনকে কাঠামোবদ্ধ করে জাতিসত্তার রাজনীতির বিশেষ কিছু চিহ্ন ধরে। লালনের মৃত্যুর পনের দিন পরে পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় একটা বেনামী লেখা ছাপা হয় লালনের মহাপ্রয়াণের ওপর। সেখানে মিথের বীজ বপন করা হয় যে, ‘সাধারণে প্রকাশ’ জাতিতে তিনি কায়স্থ ছিলেন এবং চাপড়ার ভৌমিকেরা তাঁর আত্মীয়। এইটুকু অনুসরণ করে বেশ কিছুকাল পরে মিথটিকে আরও পল্লবিত করে তোলেন শ্রী বসন্তকুমার পাল কলকাতার প্রবাসী পত্রিকায়। কবি জসিমউদ্দীন এর প্রতিবাদে লেখেন, ‘‘এমনকি তিনি লালনের পিতামাতার পরিচয় দিতেও কুণ্ঠিত হন নাই। আমরা কিন্তু লালনের গ্রামের কাহারো কাছে এরূপ বৃত্তান্ত শুনি নাই’’।[১৯] যে ভোলাই শাহের দোহাই দিয়ে বসন্তকুমার লালনের জন্মস্থান, পিতামাতা, জাত খোয়ানোর কাহিনী সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন, সেই ভোলাই শাহের কাছেই জসিমউদ্দীন জানতে চেয়েছিলেন এসব কাহিনীর সত্যাসত্য। ভোলাই শাহ জসিমউদ্দীনকে বলেন, ‘‘অনেকে তাঁর সম্বন্ধে অনেক কথাই বলে বটে, কিন্তু কেউ প্রকৃত ঘটনা জানে না’’।[২০]

মনের মানুষ সিনেমাটিতে মোল্লা ও পুরুতদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার দৃশ্য আছে। তদুপরি, জাত খুইয়ে বিতাড়িত হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেবার পরে সোলেমান ওরফে কালু তাঁকে জিজ্ঞেস করে তার জাত কি, ‘হিঁদু না মোসলমান?’ লালন বলে, তার পরিচয় শুধুই ‘মানুষ’। একইভাবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কাছেও লালন বলে যে জগতে দুইটাই মাত্র জাত আছে, নারী আর পুরুষ এবং বাকি সব মানুষের অনাসৃষ্টি। এসব দেখে মনে হতে পারে যে লালনের এমন এক চরিত্র খাড়া করা হয়েছে যা জাত-পাতের প্রশ্নের উর্ধ্বে। কিন্তু মনোযোগ দিলে সুনীল-গৌতমের কৌশলী কাঠামো শনাক্ত করতে অসুবিধা হয় না। এর আদি উপকরণ হিতকরী পত্রিকা আর বসন্তকুমার পালরাই সরবরাহ করেছিলেন। মনের মানুষ সিনেমা যাত্রা শুরু করে এই কল্পিত জন্ম বৃত্তান্ত ও জাত খোয়ানোর মিথটি আশ্রয় করে এবং এমনভাবে পরবর্তী দৃশ্যসমূহ সাজানো হয় যে ফকিরি নেবার পরেও লালনকে ‘লালন চন্দ্র কর’ হিসেবে চিনতে অসুবিধা হয় না। এমনকি, গুরু সিরাজ সাঁইয়ের দৃষ্টিগ্রাহ্য উপস্থিতি ও অনুসরণ সত্ত্বেও লালনের গা থেকে হিন্দুত্বের গন্ধটুকু মোছে না। তবে, এই প্রচেষ্টার রূপ সাংস্কৃতিক, উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির খেলার মাধ্যমে লালনের এই রূপকল্প গড়ে তোলা হয়।

লালনের এ রূপকল্প চিনতে, আমরা মনের মানুষ সিনেমায় উপস্থিত ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনুপস্থিত রাখা কিছু ইমেজের প্রতি নজর করতে পারি। কৃষ্ণপ্রসন্ন কবিরাজের ঘোড়া লালু নিয়েছিল কিনা তা শনাক্ত করার জন্য কাজের মেয়ে বীনার ডাক পড়ে, সে চিনতে পারে, লালুর পরিচয় তার কাছে: ‘‘নিত্যবাবুর আখড়ায় যাত্রপালায় নেতাই সেজেছিল, দুহাত তুলে কী নাচ! খুব ভালো গান করতি পারে’’। এ দৃশ্যকল্প লালনকে পাটাতন দেয় গড়ে উঠবার। ঘোড়া সত্যিই চুরি করেছিল কিনা সেটা প্রমাণের জন্য ঘোড়ার পিঠে চড়ে দেখাতে বলে করিবাজ। কারণ তার ‘রানী কোনো অচেনা মানুষকে পিঠে রাখে না’। দেখা গেল ঘোড়াটি দিব্যি লালনের বশমানা। তাকে পিঠে রাখলো। ন্যারেটিভ-এ আইকন নির্মাণের এটা এক পরিচিত কৌশল। সিনেমায় দেখা যায়, ছোটবেলা থেকেই বাউল ফকিরদের প্রতি লালুর বিশেষ আগ্রহ ছিল, নিজেও গান বাঁধে। শুরুর দিকেই আমরা দেখি, কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন সেনের সাথে কিশোর লালু গেছে গঙ্গাস্নানে। সন্ধ্যায় কবিরাজ মশাই তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বিশ্রাম করছেন, আর লালু গান শোনাচ্ছে, ‘‘আর আমারে মারিস নে মা/বলি মা তোর চরণ ধরে/ননী চুরি আর করবো না।’’ এটা লালনেরই গান- গোষ্ঠের রাখাল শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে এ গানের কাহিনী। আর এটাও মনে রাখতে পারি, কৃষ্ণপ্রসন্ন বাবু তাকে ঘোড়ার রাখাল হিসেবে সাথে নিয়ে গিয়েছেন গঙ্গাস্নানে। পরিচালক অন্য কোনো গান ব্যবহার করতে পারতেন, কিম্বা কোনো গান ব্যবহার না করেই দৃশ্যটা সাজাতে পারতেন। লেখক ও পরিচালকের ‘আমি’ সত্তাকে

মনের মানুষ, চিত্র ২: গঙ্গাস্নানে গিয়ে ঘোড়ার রাখাল লালু গাইছে ‘আর আমারে মারিসনে মা’

বিচারে নিলে আমরা দেখব এ গান ব্যবহার অনিবার্য ছিল। এ গান বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয় একারণে যে লালু এই গঙ্গাস্নানে গিয়েই বসন্ত আক্রান্ত হয় এবং সঙ্গীরা তাকে মৃত ভেবে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়। এবং এক মুসলমান নারী তাকে নদীবক্ষ থেকে উদ্ধার করে সেবাসুশ্রুষার মাধমে সুস্থ করে তোলেন। তাই এই ‘পরের মাকে’ লালন মা বলে ডাকে, আপন মায়ের গৃহে আর না-থেকে। দর্শক মনে লালনের জীবন ও শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে সাদৃশ্য তৈরিতে এ গান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে একথা বলা যায় এবং আমাদের কাছে স্পষ্ট করে তোলে পরিচালক লালনের কোন ইমেজ নির্মাণে অগ্রসর হচ্ছেন।

সেবাসুশ্রুষায় লালু কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। বসন্তরোগ তাকে প্রাণে না-মারলেও কেড়ে নিয়েছে স্মৃতিশক্তি। নিজের নাম-পরিচয়-ঠিকানা কিছুই মনে করতে পারে না। সিরাজ সাঁই এসেছে লালনের প্রাণদাত্রী রাবেয়ার কুটিরে। তার মনে হয় এর আগেও কোথায় যেন লালুর মুখ তিনি দেখেছেন। একদিন নদীর কূলে বসে লালু গান করছে, পাশে এসে সিরাজ সাঁই বসে: ‘‘এইতো মনে পড়েছে!’’ সে লালুকে ঝাঁকুনি দেয়, ‘‘মনে পড়ে তোর নাম?’’ হঠাৎ স্মৃতিশক্তি ফিরে আসে লালুর, গড়গড়িয়ে বলে দেয়: ‘‘লালন চন্দ্র কর’’। সুনীলের উপন্যাসে দেখা যায়, লালু সমাজ বিতাড়িত হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেবার পরে নতুন নাম ধারণ করে লালন। কিন্তু পরিচালক লালনকে কর বংশের ছেলে হিসেবে পুরো পদবীসহ প্রতিষ্ঠিত করে নেন। অকস্মাৎ স্মৃতি ফিরে আসায় হতচকিত কণ্ঠ দিয়ে শুধু লালু বা লালন নামটুকুই বেরিয়ে আসে না, পরিচালকের পরিকল্পনামতোই গলা দিয়ে বেরোয় ‘‘লালন চন্দ্র কর’’।

তো কৃষ্ণের মতো যে লালন চন্দ্র কর, বাবরি মসজিদ ধ্বংস-পরবর্তী এ দুনিয়ায় যিনি নিজেই একটা দর্শন, যা কিনা ধর্মীয় সহনশীলতার শিক্ষা দেয়, এবং সর্বোপরি, যিনি ‘বাঙালির প্রাণের ধন’, যার হাত হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলনের জন্য প্রসারিত, তিনি যবনের স্পর্শে জাত খোয়াতে পারেন বটে, কিন্তু সারাজীবন তো আর মুসলমানদের ঘরে বাস করতে পারেন না! তাই সুনীল ও গৌতম তাকে জঙ্গলে পাঠিয়ে দেন- নতুন সমাজ গড়বার জন্য।

মনের মানুষ, চিত্র ৩: জঙ্গলের ভিতরে শিমুলতলায় আনন্দনৃত্য


মনের মানুষ, চিত্র ৪: সাধুসঙ্গ নয়, বসে নাচ-গানের আসর

আর এই নতুন সমাজ গড়বার মহানায়কের আবির্ভাবের জন্য গোপন করতে হয় অনেক কিছু। ছেঁউড়িয়ায় মুসলমান জোলা সম্প্রদায়ের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়েই লালন তাঁর সাধকজীবন পার করেন। শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মলম শাহ তাঁকে চার একর জমি দান করেন বসবাসের জন্য। সেখানেই লালনের আখড়া ও সমাধি। পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকায় লেখা হয়েছিল: ‘‘লালন ফকীর নাম শুনিয়াই হয়ত অনেকে মনে করিতে পারেন ইনি বিষয়হীন ফকীর ছিলেন; বস্ত্ততঃ তাহা নহে; ইনি সংসারী ছিলেন; সামান্য জোতজমা আছে; বাটীঘরও মন্দ নহে। জিনিসপত্রও মধ্যবিত্ত গৃহস্থের মত। ইঁহার সম্পত্তির কতক তাঁহার স্ত্রী, কতক ধর্ম্মকন্যা, কতক শীতলকে ও কতক সৎকার্য্যে প্রয়োগের জন্য ইনি একখানি ফরমমাত্র করিয়া গিয়াছেন।’’[২১] এসব তথ্য তাই গোপন করতে হয়। গোপন করতে হয় পালিত কন্যা ও সাধনসঙ্গী, আর দেহসাধনাকে। কারণ ঋষি ইমেজ নির্মাণের জন্য এগুলো ঠিক মানানসই নয়। সিনেমায়, তার বদলে, লালনকে কেন্দ্র করে জঙ্গলের শিমুলতলায় তাই গড়ে ওঠে এক আনন্দবাজার, আর সব্বাই সেই সর্গে ‘আনন্দ করে’ দিন যাপন করে। লালন সমাজবিতাড়িত মানুষদের আশ্রয় ও নেতা হয়ে ওঠেন। হিন্দু-মুসলমান জাতপাতের বালাই নাই। তার কাজ কেবল সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন–পুরুত ঠাকুর ও মৌলভীদের–মোকাবিলা করা আর গান বাঁধা। সেখানে সাধু সঙ্গ নয়, বসে নাচ-গানের আসর। সেহেতু সেখানে সাধুরা আলেক (আল্লাহ এক) দেয় না, চাইল-পানি নিয়ে। কমলি ও ভান্তির জন্য তিনি সাধনসঙ্গী জুটিয়ে দেন। কমলি ঠাইরেন তার শরীর জাগাতে পারলেও মন জাগাতে পারেন না, ভান্তিকেও তিনি সাধনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন না। কারণ তিনি যে হিন্দু ঋষি! এজন্যই বোধকরি, বিশেষ বিশেষ সময়ে তিনি শাঁখ বাজান- যা হিন্দু পরিবারগুলোর নৈমিত্তিক ধর্মীয় চর্চার এক চিহ্ন হিসেবেই পাঠ করা সম্ভব।

মনের মানুষ, চিত্র ৫: লালন মাঝেমধ্যে শাঁখ বাজান

সুধীর চক্রবর্তী ব্রাত্য লোকায়ত লালন গ্রন্থে প্রশ্ন তুলেছেন: ‘‘লালন ফকিরের জীবন বিবরণ নিয়ে হালফিলের গবেষকদের এত আলো-আঁধারী, তাঁর কাব্যসত্য বা জীবনপ্রত্যয়কে একপাশে সরিয়ে রেখে তাঁর জন্মস্থান আর জাতিবর্ণ নিয়ে তর্ক ও বিতর্ক কেন প্রাধান্য পেয়ে গেল?’’[২২] তিনি এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেননি। বরং আক্ষেপ করে বলেছেন: ‘‘লোকায়ত গুহ্যসাধনা অনেকটাই দেহবাদী আচরণঘটিত এবং তার বিশেষ অনুভব থেকেই উঠে আসে গান। এসব ক্ষেত্রে তাই সাধক-জীবনের বাহ্য ঘটনার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে ব্যক্তির একান্ত সাধনার অতলতা। কিন্তু লালন সম্পর্কে আমাদের কৌতুহল বা অনুসন্ধান সম্পূর্ণ উল্টোপথে চলেছে।’’[২৩] এই উল্টোপথ বস্ত্তত রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতির পরিচয় প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত–যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক অভিলাষে পূর্ণ। সুনীল-গৌতমের নির্মাণের মধ্যে সেই অভিলাষেরই লালায়িত জিভ লকলকিয়ে ওঠে।



মনের মানুষ, চিত্র ৬: ঠাকুরবাড়ির ফ্রেমের ভিতরে থেকে লালনকে দেখা

একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় বাংলাদেশের কোনো পরিচালক সিনেমা বানালে ঠাকুরবাড়ির ফ্রেমের ভিতর দিয়ে লালনকে দেখতেন না; অন্য কোনো পরিপ্রেক্ষিত, লালনের অন্য কোনো অবয়ব ফুটে উঠতো চলচ্চিত্রটি জুড়ে। গৌতম ঘোষের মনের মানুষ সিনেমাটিতে লালনের জীবনকাহিনীর জন্য ঠাকুরবাড়ি কেন মুখ্য হয়ে উঠল এই সওয়াল আমরা করতে পারি। সিনেমাতে দেখি, কুঠিবাড়িতে গভীর রাত পর্যন্ত জীবনকাহিনী বর্ণন শেষে লালনকে জমিদার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আখড়াটি ‘নিষ্কর হিসেবে পাট্টা’ লিখে দেবার জন্য নায়েব সচীন্দ্রনাথকে নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এরকম আশবাসের কাহিনী অনেক পল্লবিত হলেও কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি। লালন গবেষক শক্তিনাথ ঝা অনেক বছর পরের একটা ঘটনা লিখেছেন: ‘‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের নাম জড়িয়ে নানা ধরনের কল্প-কাহিনী রচনা করেছেন বিভিন্ন গবেষক, গ্রন্থাকার এবং উচ্চবর্গের ভদ্রলোকেরা। সর্বত্র ‘দাতা’ রবীন্দ্রনাথ, গ্রহীতা লালন। … জমিদারদের দিয়ে [লালনের] সমাধি বাঁধানোর চেষ্টা করেছিলেন মনিরুদ্দীন [শাহ]। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে জমিদাররা এতে কোন সাহায্য করেনি। … আর ভোলাই, মানিক শীতলের মৃত্যুর পর আখড়ার অনেক খাজনা বাকি পড়ে এবং জমিদারগণ ১৯৪৫-এর ১১ই ডিসেম্বর খাজনার জন্য আখড়াটি নিলামে তোলেন। লালনের শিষ্যরা ১ শত ৭ টাকা ৪ আনা দিয়ে নিলামে সম্পত্তি খরিদ করে আখড়ার অস্তিত্ব রক্ষা করেন। এ-বিষয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।’’[২৪] আমরাও আর বাড়তি মন্তব্য করবার প্রয়োজন বোধ করছি না, বরং রবীন্দ্রনাথের লালন-পিরিতি সম্পর্কে আরেক গবেষকের মন্তব্য পাঠ করি এইখানে। সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘‘… একটা কথা ভাবলে আশ্চর্য লাগে যে, রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে লালন বা বাউল নিয়ে যেমন মেতেছিলেন পরবর্তীকালে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। যদিও রবীন্দ্রনাথের নানা গানে বাউল গানের অন্তঃস্পন্দ শোনা যায়, তবু কোনো কারণে বাউলদের সম্পর্কে তাঁর প্রাথমিক উৎসাহে ভাঁটা পড়ে। … বাউলদের ‘মনের মানুষ’ তত্ত্বের ভাবালুতা তাঁকে এককালে যতটা উদ্বেলিত করেছিল পরে তাদের জীবনযাপনের মুক্ত ধরণ, বস্ত্তবাদ ও তর্কমুখী তাত্ত্বিকতা তাঁকে ততোটা টানেনি।’’[২৫] সহি বাত। আমাদের জন্য যে মার্গসংস্কৃতির প্রতিমা গড়েন রবীন্দ্রনাথ সেই প্রতিমার বেদী হিসেবেও বেশরা ফকির লালনের বস্ত্তবাদিতা, নারী-পুরুষের মুক্ত সম্পর্ক চর্চা কিংবা তর্কমুখিতা গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্য শুধু সেটুকুই যা মার্গসংস্কৃতির খাপে আঁটে। তবু যখন মনের মানুষ সিনেমায় ঠাকুর বাড়ির জানালার গরাদ ভেদ করে লালনের জীবনে প্রবেশ করতে হয়, তার ভিন্ন প্রয়োজন, ভিন্ন এক উদ্দেশ্য নজর এড়ায় না।

তাই বলছিলাম, জমিদার ঠাকুর পরিবারের জৌলুষ আরও বাড়িয়ে তোলার জন্যই মনের মানুষ সিনেমা এরকম ‘পাট্টা’ লিখে দেবার গুজবকে প্রতিষ্ঠিত করে- সেটা বলা যাবে না। বাঙালি সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের পদচিহ্ন ধরে ধরেই আমাদের এগোতে হয়। আমরা দেখতে পাই, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে ঠাকুরবাড়ির ফ্রেম আর তার নিশানা ধরে লালনের জীবন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। তাই বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ এমন এক আইকন যার সংস্পর্শে বেশরা ফকির লালন ‘‘বাঙালির প্রাণের সম্পদ’’ হিসেবে এই সিনেমা মারফত হিন্দু মধ্যবিত্তীয় পরিসরে আত্মসাৎ হয়ে যায়। তবে এটুকুও বলে রাখা দরকার যে, লালনের প্রাণস্পন্দন গোপন করেই কেবল মার্গ সংস্কৃতি তাকে হজম করার চেষ্টা করতে পারে। কারণ, তার প্রাণস্পন্দনটুকুর স্বীকৃতি দিতে হলে মার্গ সংস্কৃতিই বেসামাল হয়ে পড়বার আশঙ্কা থাকে। অতঃপর, এর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝতে সিনেমার শেষ দৃশ্যের দিকে নজর দিতে পারি আমরা। জমিদারবাড়ি থেকে বেরিয়ে লালন গগন হরকরার কুঠিতে শেষ রাতটুকু যাপন করেন। গগন তার নিজের একটা গান শোনায় লালনকে: ‘‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।’’ গগনের এই গানে মনের মানুষের সন্ধান করা হলেও, আমরা অনেকেই জানি যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের অন্তরে লুকিয়ে আছে এ গানের সুর। আমরা অনেকেই এটাও হয়তো জানি যে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ কোলকাতার ভদ্দরলোকেরা মেনে নেয় নি। তারা বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য উঠেপড়ে নেমেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরির মাধ্যমে ঔপনিবেশিক শাসক বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করে দেবার জন্য কার্জন সাহেব বাংলাকে দুইভাগ করেছেন। সরল পাঠে এ যুক্তি ঠিকই যে ঔপনিবেশিক শাসকদের এরূপ উদ্দেশ্য ছিল। তবে একথাও ঠিক যে, হিন্দু-মুসলমানের ভিতরে বিরাজমান প্রবল বৈষম্যপূর্ণ একটা আর্থ-সামাজিক বিন্যাস ছাই-চাপা রেখেই জাতীয়তাবাদী হিন্দু নেতৃত্ব বঙ্গভঙ্গ রদ করতে নেমেছিল। যে-কারণে, পূর্ববাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানেরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়নি, তারা বরং কলকাতার বাবুদের আধিপত্য ও শোষণের বাইরে এসে ঢাকাকেন্দ্রীক মুসলমানদের নতুন এক অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখেছিলেন বঙ্গভঙ্গের ভিতরে। কলকাতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। এই আন্দোলনে উৎসাহ যোগাতেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’’। এ গানে লুকিয়ে আছে, যুক্তবাংলার স্বপ্ন। আজকের জমানায় এই স্বপ্নের তাৎপর্য অনুধাবন করা আমাদের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে।


মনের মানুষ, চিত্র ৭: মিলন হবে কত দিনে…

যাহোক, অবিভক্ত সোনার বাংলার প্রতি কোলকাতার ভদ্দরলোকদের এই ভালোবাসা কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৪৭-এ পূর্ববাংলার মুসলমানেরা একবাক্যে পাকিস্তানের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, সে কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক দেশভাগে কলকাতার ভদ্দরলোকদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের অবদানও কম ছিল না। চল্লিশের দশকে জমিদারী আর কোনো লোভনীয় কারবার ছিল না, ফলে পূর্ব বাংলায় জমিদারীর বদৌলতে কোলকাতায় বাবুগিরি করা দুষ্কর হয়ে ওঠে। তদুপরি দেখা গেল, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার ক্ষমতা নির্ধারিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের তাঁবে থাকতে হবে ‘অগ্রসর’ হিন্দু সম্প্রদায়কে। সুতরাং, দেশভাগের মাধ্যমে অন্তত অর্ধেক বাংলার ওপর কর্তৃত্ব রক্ষা করা সম্ভব হবে ভেবেও তারা দেশভাগ সমর্থন করে। তথাপি, যুক্তবাংলার স্বপ্ন, এক রোমান্টিকতা, এক রাবীন্দ্রিক ভাবালুতা এখনও আমাদেরকে আচ্ছন্ন রাখে। তাই চলচ্চিত্রটিতে দেখি, ভোর হয়, লালন কুটির থেকে বেরিয়ে পাশ দিয়ে বয়ে চলা কুয়াশা ঢাকা নদীবক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দূরের প্রতিবেশী পাড়া থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসে—যেন স্মরণ করিয়ে দেয় যে মুসলমানেরাও এদেশের বাসিন্দা, যদিও দূরের পাড়াগাঁয়ে তাদের বাস, তাদের উপেক্ষা করো না। আর তাই যেন লালন গেয়ে ওঠেন, ‘মিলন হবে কতো দিনে, আমার মনের মানুষের সনে।’ এখানেই সিনেমার সমাপ্তি ঘটে। আর আমাদেরকে একগাদা প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয়।

দুঃখের কথা হলো, এই মিলনের জন্য, নতুন বাঙালি সমাজ গড়বার জন্য মনের মানুষ সিনেমায় লালনের অবয়বজুড়ে জাত-পাত না-মানা একজন হিন্দু ঋষির প্রতিমা গড়ে তোলা হয়েছে। আমার আপত্তি লালনকে নিয়ে এই হিন্দু ঋষি-ইমেজ নির্মাণের বিরুদ্ধে। কারণ, গত শতকের ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে যেমন লালনকে শরিয়তী ধারার ‘সুফি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার এক সাম্প্রদায়িক চেষ্টা সবার নজরে এসেছিল, গৌতম-সুনীলের প্রচেষ্টা তার-ই উল্টোপিঠ। ইসলামপন্থীদের প্রচেষ্ঠা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে সহজেই শনাক্ত হতে পারে আমাদের চোখে। কিন্তু গৌতম-সুনীলের প্রচেষ্ঠাকে আমরা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বলে চিনতে পারি না। কারণ, সাধারণত প্রকাশের উপরিতল অধ্যয়ন করে আমরা মনে করি যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা সবসময় কেবল ধর্মীয় ‘চিহ্ন’ বা ইস্যুগুলোকে আশ্রয় করেই প্রকাশিত হয়। কিন্তু, জাতিসত্তার রাজনীতিতে এটাও দেখা যেতে পারে যে, ধর্মীয় ‘চিহ্ন’ প্রতিস্থাপিত হয়ে সংস্কৃতি, শিক্ষা ইত্যাদি সাম্প্রদায়িকতার ‘চিহ্ন’ হয়ে উঠেছে, গত শতকের প্রথমার্ধে ‘নবজাগরিত সংস্কৃতিবান’ হিন্দু জনগোষ্ঠীর বেলায় যেরূপ হয়েছিল।[২৬] এসব সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার সাম্প্রদায়িক ঝোঁক চেনা দরকার–বিশেষতঃ তা যখন একজন বেশরা ফকিরকে ‘বাঙালির প্রাণের ধন’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে তার প্রাণস্পন্দনটুকুই হরণ করতে উদ্যত হয়। জাতি আর কাহিনীর যে কল্পনা আমাদের মনে উদয় হয় তার প্রকৃতি একইরকম- সময়ের মিথের ভিতরেই তার বাস। আর সে মিথ নির্মাণ প্রকল্পগুলো রাজনৈতিক অভিলাষে পূর্ণ।
ফুটনোট:

[১.] Homi K. Bhaba. ‘Introduction: narrating the nation’, in Her (ed) Nation and Narration. Rourledge. 2006. First published in 1993. P. 1.

[২.] গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল (২০০৮)। মনের মানুষ। আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা। পৃ. ১৯৬।

[৩.] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৭।

[৪.] গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল (২০০৮)। মনের মানুষ। আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা।

[৫.] মাইনুল ইসলাম, গৌতম ঘোষের ‘‘মনের মানুষ’’, দৈনিক ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ১০, ২০১০।

[৬.] Gautam Ghosh’s ‘Moner..’ wins Golden Peacock at IFFI, Outlook, Dec 2, 2010.

[৭.] মাইনুল ইসলাম, গৌতম ঘোষের ‘‘মনের মানুষ’’, দৈনিক ইত্তেফাক, ডিসেম্বর ১০, ২০১০।

[৮.] http://www.bbc.co.uk/bengali/multimedia/2010/12/101223_mk_moner_manush.shtml?

[৯.] সমরেশ মজুমদার, মনের মানুষ: তবু যা পাওয়া গেল চুমুক দিয়ে খাবার পরেও আলোড়িত থাকার মতো, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৬ মার্চ ২০১১, কোলকাতা।

[১০.] দিনমজুর নামে সাহোয়ার ইন ব্লগ-এ লেখাটি (http://www.somewhereinblog.net/blog/dinmojurblog/29303065) ছাপা হয়েছে। ফেসবুকে কল্লোল মোস্তফা স্বনামে লেখাটি পোস্ট করেছেন।

[১১.] অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়। ১৯৬৬। বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত। ৩য় খন্ড। কলকাতা। পৃষ্ঠা ১২০৬-২১।

[১২.] শক্তিনাথ ঝা। ফকির লালন সাঁই: দেশ কাল শিল্প। সংবাদ, কলকাতা ১৯৯৫।

[১৩.] শক্তিনাথ ঝা। ফকির লালন সাঁই: দেশ কাল শিল্প। সংবাদ, কলকাতা ১৯৯৫। পৃ. ২০৩।

[১৪.] শক্তিনাথ ঝা। ফকির লালন সাঁই: দেশ কাল শিল্প। সংবাদ, কলকাতা ১৯৯৫। পৃ. ১৫৩।

[১৫.] আবুল আহসান চৌধূরী। ২০০৮। লালন সমগ্র। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা। পৃ. ৭৩২।

[১৬.] আবুল আহসান চৌধূরী। ২০০৮। লালন সমগ্র। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা। পৃ. ৭৩৮।

[১৭.] সুধীর চক্রবর্তী। ১৯৯২। ব্রাত্য লোকায়ত লালন। পুস্তক বিপণি, কলকাতা। পৃ. ৭০।

[১৮.] শক্তিনাথ ঝা। ফকির লালন সাঁই: দেশ কাল শিল্প। সংবাদ, কলকাতা ১৯৯৫। পৃ. ১৫৩।

[১৯.] জসিমউদ্দীন, লালন ফকির। আবুল আহসান চৌধূরী। ২০০৮। লালন সমগ্র। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা। পৃ. ৭৬৪।

[২০.] জসিমউদ্দীন, ‘‘লালন ফকির’’, আবুল আহসান চৌধূরী (সম্পা)। ২০০৮। লালন সমগ্র। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা। পৃ. ৭৬৪।

[২১.] মহাত্মা লালন ফকীর, পাক্ষিক হিতকরী, ১৫ কার্তিক ১২৯৭/৩১ অক্টোবর ১৮৯০। উদ্ধৃত, আবুল আহসান চৌধুরী (সম্পা)। ২০০৮। লালন সমগ্র। পাঠক সমাবেশ, ঢাকা। পৃ. ৭০৮।

[২২.] সুধীর চক্রবর্তী। ১৯৯২। ব্রাত্য লোকায়ত লালন। পুস্তক বিপণি, কলকাতা। পৃ. ৪৭।

[২৩.] সুধীর চক্রবর্তী। ১৯৯২। ব্রাত্য লোকায়ত লালন। পুস্তক বিপণি, কলকাতা। পৃ. ৪৭-৪৮।

[২৪.] হারামনি, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৪-৬৫, উদ্ধৃত, শক্তিনাথ ঝা। ফকির লালন সাঁই: দেশ কাল শিল্প। সংবাদ, কলকাতা ১৯৯৫, পৃ. ১৭৫।

[২৫.] সুধীর চক্রবর্তী। ১৯৯২। ব্রাত্য লোকায়ত লালন। পুস্তক বিপণি, কলকাতা। পৃ. ৭২।

[২৬.] জয়া চ্যাটার্জী বেঙ্গল ডিভাইডেড: হিন্দু কমিউনালিজম এন্ড পার্টিশন, ১৯৩২-১৯৪৭ (কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস ১৯৯৪) গ্রন্থে এবিষয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। বিশেষত, দ্য কনস্ট্রাকশন অব ভদ্দরলোক কমিউনাল আইডেনটিটি: কালচার এন্ড কমিউনালিজম ইন বেঙ্গল অধ্যায়টি দেখা যেতে পারে।

No comments:

Post a Comment